ভারতে বড় বিনিয়োগ, দুশ্চিন্তা এ দেশে

 তিন বছরে সাতটি বৃহৎ বস্ত্রপল্লি করবে ভারত। দেশীয় উদ্যোক্তারা বলেছেন, প্রতিযোগী দেশ বড় বিনিয়োগে গেলে তা দেশের জন্য হুমকি হবেই।




তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের রপ্তানি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে ভারত তিন বছরের মধ্যে সে দেশে সাতটি বৃহৎ টেক্সটাইল পার্ক বা বস্ত্রপল্লি করার পরিকল্পনা করেছে। এর একেকটি বস্ত্রপল্লি ১ হাজার একরের বেশি জমির ওপর স্থাপিত হবে। সেখানে গড়ে তোলা হবে বিশ্বমানের অবকাঠামো। এর সঙ্গে বস্ত্র খাতের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ম্যান মেইড ফাইবার বা কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনের জন্য ১০ হাজার ৬৮৩ কোটি রুপির প্রণোদনা স্কিমের পরিকল্পনা করছে দেশটি।

চলতি মাসের প্রথম দিন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার দিন ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ দেশজুড়ে ৭টি বৃহৎ টেক্সটাইল পার্ক গড়ে তোলার একটি প্রকল্পের ঘোষণা দেন। বিষয়টি ভারতের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।

দ্য ইকোনমিক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের বস্ত্র মন্ত্রণালয় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ দ্বিগুণ করে ৩০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করতে দেশজুড়ে ৭টি সমন্বিত বস্ত্র অঞ্চল ও পোশাকপল্লি করার প্রস্তাব দিয়েছিল অর্থমন্ত্রীকে। সেখানে নিরবচ্ছিন্ন পানি, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অবকাঠামো এবং গবেষণার জন্য পরীক্ষাগার রাখার কথা বলা হয়েছে।


ভারতের বিনিয়োগকে হুমকি ভাবার কিছু নেই। তবে আমাদের চোখ খোলা উচিত। রপ্তানিতে এগোলেও দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান নেই আমাদের। যদিও আমরা যা যা চাই, সরকার সাধ্যমতো সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।



এদিকে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র রপ্তানি খাত নিয়ে ভারতের বিশাল পরিকল্পনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাদের আগ্রাসী বিনিয়োগ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে রপ্তানি বাজার হারানোর শঙ্কা রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন।

বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ভারত বস্ত্র ও পোশাক খাতে যেভাবে বিনিয়োগ করছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই হুমকি। কারণ, পোশাক রপ্তানিতে ভারত আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও বস্ত্র খাতে তারা অনেক শক্তিশালী।’ তিনি বলেন, ‘ভারত যেখানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছে, সেখানে আমরা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। সমস্যা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে ঝোঁক বেশি। প্রতিযোগিতায় টিকতে ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করার পাশাপাশি ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা দূর করতেও ব্যবস্থা প্রয়োজন।’

তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে পোশাক রপ্তানিতে পেছনে ফেলতে ২০১৬ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা একটি বিশেষ প্যাকেজ অনুমোদন করে। তখন তাদের পরিকল্পনা ছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানি অন্তত ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ভারত পরিকল্পনামাফিক এগোতে পারেনি, বাংলাদেশকেও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়নি। অবশ্য ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামের চেয়ে বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানিতে এগিয়ে ছিল ভারত। এরপর দেশটি পিছিয়ে পড়তে থাকে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ আর ২০১১ সালে ভিয়েতনাম থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ে ভারত।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে ভারত। একই বছরে সমপরিমাণ অর্থাৎ ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের কাপড় রপ্তানি করে দেশটি। অন্যদিকে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৪০০ (প্রকৃতপক্ষে ৩ হাজার ৩০৭ কোটি ডলার) এবং ভিয়েতনাম ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে।

ভারত পিছিয়ে থাকলেও দ্রুত সামনের সারিতে পৌঁছানোর জন্য অনেক কিছু করছে বলে মন্তব্য করলেন বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর পরিচালক বাদশা মিয়া। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের যেসব উদ্যোক্তা ভারত থেকে তুলা আমদানি করেন, তাঁদের বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন ভারতীয়রা। ভারতের বিনিয়োগ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের জন্য হুমকি হবে বলে মনে করেন বাদশা মিয়া।

বাংলাদেশও যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেনি, তা নয়। ২০১৫ সালে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক রপ্তানি ৫ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যেতে একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা প্রণয়ন করে। এতে অবকাঠামো নির্মাণ, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, সংস্কারকাজ সম্পন্ন, শ্রমিকের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, নতুন বাজার অনুসন্ধান ও পোশাকের ন্যায্যমূল্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। শুরুতে পথনকশাটি নিয়ে বেশ আলোচনা থাকলেও পরে ধীরে ধীরে সব পক্ষই নীরব হয়ে যায়। করোনাভাইরাসের চ্যালেঞ্জ যুক্ত হওয়ায় গত বছর পোশাক রপ্তানি উল্টো ১৭ শতাংশ কমে ২ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারে নেমে আসে।

No comments

Theme images by Jason Morrow. Powered by Blogger.