যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানি বেড়েছে ৬০%
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানি বেড়েছে ৬০%
এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই দেশের পোশাক খাতে একটি সুখবর এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালের জানুায়ারি-জুলাই সময়ের চেয়ে ২০২২ সালের একই সময়ে এই রফতানি বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা)’র এক পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানি বৃদ্ধির বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও সামনের দিনে রফতানি কমে যাওয়ার আশঙ্কাকে এখনই উড়িয়ে দিচ্ছে না এই খাতের উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতনিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পোশাক পণ্য রফতানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক পণ্যের রফতানি বাড়ার কারণ হচ্ছে করোনার পর সেখানে চাহিদা বেড়েছে। করোনার সময় বেশিরভাগ শোরুম বন্ধ ছিল। ফলে করোনার পর তারা ক্রয় বাড়িয়েছে। আবার চীনে যে অর্ডার যেত সেইসব অর্ডারও আমাদের দেশে এসেছে। বিষয়টি খুবই ইতিবাচক।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পোশাক খাতের রফতানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা এখনও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, লোডশেডিং বেড়েছে, এসব কারণে ফ্যাক্টরিও বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বায়াররা কাজ দিলেও আমরা হয়তো করতে পারব না। জ্বালানির দাম বাড়ায় আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়বে। আবার উৎপাদনও কমবে। সবমিলিয়ে ভবিষ্যতে রফতানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর সব কিছু নির্ভর করছে দেশে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ পরিস্থিতির উপর।’
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের রফতানি ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এই আদেশগুলো মে মাসে দেওয়া হয়েছিল, যখন বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখনকার মতো অস্থির ছিল না। আমরা এই বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করছি যে, এই বৃদ্ধি শুধুমাত্র একটি স্বল্পমেয়াদী ঘটনা, এটি টেকসই নয়।’
তিনি বলেন, ‘জ্বালানির উচ্চ মূল্য এবং সরবরাহের ঘাটতি বিশ্ব পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যেহেতু আমরা বিশ্ববাজারে কাজ করি, আমাদের শিল্পও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। গত দেড় বছরে সুতার দাম বেড়েছে ৬২ শতাংশ, মালবাহী খরচ বেড়েছে ৫০০ শতাংশ, রাসায়নিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ন্যূনতম মজুরি গত বছরের শুরুতে সাড়ে ৭ শতাংশ বেড়েছে। ফলে আমাদের গত পাঁচ বছরে গড় উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। সেইসঙ্গে উত্পাদনশীলতা এবং দক্ষতা আমাদের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় ৪৫ শতাংশ, ভিয়েতনামে উৎপাদনশীলতা ৫৫ শতাংশ এবং তুরস্কে ৭০ শতাংশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নির্মাতারা পণ্য এবং বাজারের অতিরিক্ত ঘনত্ব, বিশেষ বাজারে অনুপস্থিতি, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের উন্নতি ইত্যাদির মতো দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। খরচ কমিয়ে দক্ষতা ও উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি করে প্রতিযোগিতামূলক থাকার চেষ্টা করছি।’
জানতে চাইলে দেশের নিটওয়্যার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমেরিকা-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে আমেরিকার বাজারে আমাদের পোশাক পণ্য রফতানি বেড়েছে। সম্প্রতিও চীনের কটনের ওপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সবদিক থেকে বাংলাদেশ পোশাক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে নিরাপদ। পোশাক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে নিরাপদ। এখানে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। যার কারণে ক্রেতারা বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করে। করোনার পর আমেরিকার সবগুলো স্টোর খালি হয়ে যায়। সেজন্য এখন তারা ক্রয়াদেশ বাড়াচ্ছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের রফতানি বেড়েছে। আমরা মনে করি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশাবাদী বাংলাদেশের রফতানি কমবে না। যদিও গ্যাস সংকট আমাদের জন্য বড় ধাক্কা; জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ সংকট আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। ডলার মার্কেটে বায়িং ও সেলিং রেটে যে পার্থক্য, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সেই ব্যবধান কমাতে না পারে তাহলে আমরা বিরাট ক্ষতিগ্রস্থ হব। সবমিলিয়ে আমরা ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছি। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
অটেক্সার তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আমেরিকায় অ্যাপারেল পণ্য রফতানি হয়েছে ৫ হাজার ১৯ মিলিয়ন ডলার। গত বছর (২০২১) একই সময়ের রফতানি আয়ের এই পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১৩১ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আমেরিকায় অ্যাপারেল পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৬০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
২০২১ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে চীন থেকে আমেরিকায় অ্যাপারেল পণ্য রফতানি হয়ছিল ৭ হাজার ৩১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালে রফতানি হয়েছে ১০ হাজার ২৫৩ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই বছর অ্যাপারেল পণ্য রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশ।
এর পরের অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। ২০২১ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে ভিয়তনাম থেকে আমেরিকায় অ্যাপারেল পণ্য রফতানি হয়েছিল ৬ হাজার ৮১০ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের একই সময়ে রফতানি আয়ের এই পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ১৯৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেশটিতে ভিয়েতনামের রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ৩৫ শতাংশ।
তথ্য থেকে দেখা গেছে, আমেরিকায় অ্যাপারেল পণ্য রফতানিতে শীর্ষে রয়েছে চীন। দেশেটিতে তাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি ৩৫ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬০ শতাংশ। রফতানির পরিমাণের দিক থেকে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, দেশটির প্রবৃদ্ধিও ৬০ শতাংশ। পঞ্চম অবস্থানে থাকা ভারতের প্রবৃদ্ধি ৫৭ শতাংশ। এর পরের দিকে রয়েছে মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কলম্বিয়া, পাকিস্তান ও কোরিয়া। আমেরিকায় দেশগুলোর অ্যাপারেল পণ্য রফাতনিতে প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ২০, ২২, ৫২, ৪৯ ও ৫৩ শতাংশ।
No comments