ক্রয়াদেশ কমলেও ব্যবসা দ্রুতই ফিরবে

 

ক্রয়াদেশ কমলেও ব্যবসা দ্রুতই ফিরবে


বর্তমান প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাকের রপ্তানিতে সাড়ে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে খারাপ বলা যাবে না। তা ছাড়া গত মাসে কোরবানি ঈদের কারণে কারখানাগুলো গড়ে ১০ দিন বন্ধ ছিল। বর্তমানে যেসব পোশাক রপ্তানি হচ্ছে, সেগুলোর ক্রয়াদেশ এসেছিল চলতি বছরের শুরুর দিকে। তখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল প্রায় স্বাভাবিক।
গত এক-দুই মাস ধরে ক্রয়াদেশ কম আসছে। কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আমাদের বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানুষ জ্বালানি ও নিত্যপণ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছে। ফলে পোশাকের বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি কমে গেছে। গুদামে পণ্য জমছে। আবার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, এখনই বোঝা যাচ্ছে না। অন্যদিকে তুলার দাম কমছে। সব মিলিয়ে বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চলার নীতি নিয়েছে। আমার কারখানায় গত এক মাসে নতুন ক্রয়াদেশের জন্য ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কোনো অনুসন্ধান আসেনি।



অর্থবছরের প্রথম মাসে রপ্তানি আয়েও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে বাংলাদেশ ৩৯৮ কোটি মার্কিন ডলারের সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। এই আয় গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। জুলাই মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২০৯ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই আয় ১২ শতাংশ বেশি।

প্রাথমিক হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮১ কোটি ডলার। বৈদেশিক বাণিজ্য ও প্রবাসী আয় মিলে ঘাটতি নেমেছে শত কোটি ডলারের নিচে, যা পরিমাণে ৭২ কোটি ডলার।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়তে থাকা আমদানি ব্যয় কমেছে—এটা ভালো দিক। রপ্তানি আয় আরও বাড়লে ভালো হতো। এরপরও গত বছরের তুলনায় বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। রপ্তানি আয় বাড়লে আমরা স্বস্তিকর অবস্থায় থাকব। প্রবাসী আয় যদি প্রতি মাসে দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়, তা হবে সুখবর।’

বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের প্রধান খাত আমদানি। আর আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তাই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে টান পড়ে। গত অর্থবছরে দেশে আমদানি ব্যয়ে রেকর্ড হয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও প্রবাসী আয় কমেছে। এই দুটি মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এতে ডলার নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা শুরু হয়, যা এখনো চলছে।

অনিশ্চয়তা কাটেনি
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলার নিয়ে সংকট চলছে অনেক দিন ধরে। ব্যবসায়ীদের এখন আমদানি দায় মেটাতে ডলারপ্রতি দিতে হচ্ছে ১০৫ টাকা। দিন পেরোতেই এই দরও ঠিক থাকছে না। ডলারের দরের অনিশ্চয়তায় অনেক শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ধারাবাহিকভাবে আমদানি ব্যয় বাড়ার পর জুলাই মাসে কমেছে বটে, তবে তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। অবশ্য গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে পণ্য আমদানির পরিমাণ ২৩ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৯৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। গত অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়েছিল ৩৭ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে অর্থনীতির প্রধান তিনটি সূচকে স্বস্তিকর অবস্থা থাকলেও তা কত দিন টিকবে, এ নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। ঋণপত্র খোলার হার কমে আসছে। প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল ছাড়া বিশ্ববাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম এখন কমতির দিকে। তাই সামনে আমদানি ব্যয় কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গত মাসে শস্য ও সার রপ্তানি নিয়ে রাশিয়া–ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি হওয়ার পর গত সোমবার প্রথম জাহাজ ইউক্রেনের ওদেসা বন্দর ছেড়ে যায়। ইউক্রেনের শস্য ও সার রপ্তানির দুয়ার খোলার অর্থ বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য লেনদেনের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) সোমবার থেকে পণ্যের দাম কমতির দিকে রয়েছে।

এসবই আগামী দিনে পণ্য আমদানিতে ব্যয় কমে আসার আভাস দিচ্ছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্য দুটি খাত প্রথম মাসে ইতিবাচক ধারায় থাকলেও সেটি কত দিন থাকবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে।

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানি আদেশ কমে আসায় তা সামনে বাড়বে কি না, এ নিয়ে সংশয় আছে। আবার জুলাই মাসে ঈদুল আজহার কারণে ১৪ মাসের মধ্যে প্রবাসী আয় সর্বোচ্চ পরিমাণে এসেছে। আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করবে অর্থনীতির অবস্থা। কারণ, আমদানি ব্যয় কমার চেয়ে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বেশি কমলে তাতে ঘাটতি বেড়ে যাবে।

আবার বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বগতি থাকার সময় যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে, সেসব পণ্যের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হবে সামনে। ধারাবাহিকভাবে আমদানি ব্যয় পরিশোধের সময় সামনে চাপ কিছুটা বাড়বে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আগামী কয়েক মাস যদি আমদানি ব্যয় কমে এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় ইতিবাচক ধারায় থাকে, তাহলে অর্থনীতিতে চাপ কমবে।

No comments

Theme images by Jason Morrow. Powered by Blogger.