যুদ্ধের কারণে বাধাগ্রস্ত বাণিজ্য

 

যুদ্ধের কারণে বাধাগ্রস্ত বাণিজ্য


বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানি করতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে চাইছেন না। রপ্তানিকারকেরাও পণ্য পাঠাতে দ্বিধা করছেন। একই সমস্যা দেখা দিয়েছে ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ যে পরিমাণ গম আমদানি করে, তার এক-তৃতীয়াংশই আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে।

ইফাদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইফাদ মাল্টি ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাসকিন আহমেদ বলেন, ‘যুদ্ধরত দুই দেশ থেকে আমরা সরাসরি খাদ্যপণ্য আমদানি করি না। যাঁরা করেন, তাঁদের কাছ থেকে কিনে নিই। যুদ্ধের কারণে আমদানিকারকেরা এখন দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সংগত কারণে আমাদেরও বাড়াতে হবে।’




যুদ্ধের কারণে আমদানিকারকেরা এখন দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সংগত কারণে আমাদেরও বাড়াতে হবে।
তাসকিন আহমেদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইফাদ মাল্টি ফুড







সমস্যাটা এমন একসময়ে হয়েছে, যখন রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছিল। দেশটি থেকে শুল্ক ও কোটামুক্ত (ডিএফকিউএফ) রপ্তানি সুবিধা পাওয়ার চেষ্টায়ও আছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ডিএফকিউএফ পেতে ইউরেশীয় অর্থনৈতিক কমিশনের (ইএইইউ) সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সমঝোতা স্মারক করবে বলে চূড়ান্ত আলোচনা হয়ে আছে।

এ ছাড়া মস্কোতে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য, অর্থনীতি, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিষয়ে আন্তসরকার কমিশন চুক্তি হয়েছে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর মস্কোতে বৈঠকও হয়েছে বাংলাদেশের।

রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি ব্যাংকিং সম্পর্ক নেই বাংলাদেশের। টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফারের (টিটি) মাধ্যমে লেনদেন করতে হয়। তারপর বাণিজ্য বাড়ছিল উভয় দেশের।

পাঁচ বছর আগে দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানি ছিল ৪৩ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পণ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে আমদানি ৩ কোটির চেয়ে একটু বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে রপ্তানির দিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ ইতিবাচক অবস্থানে আছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবার উভয় দেশের বাণিজ্য শতকোটি ডলার পেরিয়ে দাঁড়ায় ১১১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। এর পর থেকে প্রতিবছরই এ বাণিজ্য শতকোটি ডলারের বেশি থাকছে।

ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য খুব বড় নয়। পাঁচ বছর ধরে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডলারের মধ্যে থাকছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ইউক্রেনে রপ্তানি দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে ঠিক, তবে পরিমাণে খুবই কম।

ইউক্রেনে রপ্তানির তুলনায় দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইউক্রেনে রপ্তানির চেয়ে সেখান থেকে আমদানি হয়েছে ১৩ গুণ বেশি পণ্য। তার আগের অর্থবছরে ইউক্রেন থেকে ২০ গুণ বেশি পণ্য আমদানি হয়েছিল।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের এক সপ্তাহের মাথায় ৩ মার্চ একটি বৈঠক ডাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্রসচিব মো. মাসুদ বিন মোমেন। তবে বৈঠক থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

আমদানি-রপ্তানি পণ্য

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবি সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়ায় বাংলাদেশ রপ্তানি করে বস্ত্রপণ্য, চিংড়ি, পাট সুতা, চামড়া, মোটর পার্টস, হোম টেক্সটাইল, টেরিটাওয়েল, ফুটওয়্যার, সিনথেটিক দড়ি, টেবিলওয়্যার ইত্যাদি। আর রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে গম, সার, লোহা, রাসায়নিক পণ্য, প্লাস্টিক, ইস্পাত ইত্যাদি।

ইউক্রেন আক্রমণের তিন দিন পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও কানাডা রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর্থিক লেনদেনকারী সংস্থা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) রাশিয়ার বেশ কিছু ব্যাংকের লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সংগত কারণে রাশিয়ার সঙ্গে টিটির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করার পথ বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের, যদিও সব রুশ ব্যাংকের ওপর সুইফট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি।

রাশিয়া একটা বড় বাজার। ধীরে ধীরে এই বাজার ধরার চেষ্টায় ছিলাম আমরা। অগ্রগতিও হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ এ যুদ্ধ আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাবিবউল্লাহ ডন, সভাপতি, বিসিসিআই

এদিকে ইউক্রেনে খুব বেশি রপ্তানি বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ, রপ্তানি হচ্ছে চিংড়ি, ওভেন পোশাক, নিট পোশাক, টেক্সটাইল, তামাক, ওষুধ ইত্যাদি। তা–ও নিয়মিতভাবে রপ্তানি হয় না।

আর আমদানি করা হয় খাদ্যপণ্য, লোহা, ইস্পাত, জাহাজ, নৌকা ও নৌকার কাঠামো, এয়ারক্রাফট, স্পেসক্রাফট, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি।

কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্টস স্টেট (সিআইএস)-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সভাপতি হাবিবউল্লাহ ডন গত বৃহস্পতিবার হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাশিয়া একটা বড় বাজার। ধীরে ধীরে এই বাজার ধরার চেষ্টায় ছিলাম আমরা। অগ্রগতিও হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ এ যুদ্ধ আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে, আমদানি রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষতি পোষাতে অনেক সময় লেগে যাবে।

No comments

Theme images by Jason Morrow. Powered by Blogger.