দশের হাতে ২৪% ব্যবসা

 সম্ভাবনা থাকলেও দেশের মূলধননিবিড় এই শিল্পে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এখন নতুন বিনিয়োগ কম আসছে

২০০৩ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় ১০০ বিঘা জমির ওপর কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় বাদশা টেক্সটাইলের। এক যুগের ব্যবধানে সুতা রপ্তানিতে শীর্ষস্থান দখল করে নেয় বাদশা মিয়ার নিজ নামে ও হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠান। গত বছর প্রায় সাড়ে ৪ কোটি কেজি সুতা রপ্তানি করে বাদশা টেক্সটাইল, যার মূল্য ১১ কোটি ৬৪ লাখ মার্কিন ডলার বা ৯৮৯ কোটি টাকা।

বাদশা টেক্সটাইলসহ শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে সুতা রপ্তানির ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ ব্যবসা। সব মিলিয়ে গত বছর দেশ থেকে ২৩ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকার প্রায় ৫৭ কোটি কেজি সুতা রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ১০ প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা বা ৬৫ কোটি ৯২ লাখ ডলারের সুতা রপ্তানি করেছে।

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এমন তথ্য মিলেছে। সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী, ১২টি বস্ত্রকল গত তিন বছর ঘুরেফিরে শীর্ষ দশে অবস্থান করছে।


ভারতে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ৩০ বছর ধরে আছেন। আর আমাদের দেশের সচিব বস্ত্র খাত বুঝতে বুঝতেই অবসরে বা অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যান।


বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক-চতুর্থাংশ ব্যবসা ১০ প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকাটা ইতিবাচক নয়। তবে মূলধননিবিড় এই শিল্পে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে নতুন বিনিয়োগ কম আসছে। অথচ ওভেন পোশাক ও ডেনিম কাপড়ে ভালো সম্ভাবনা আছে। তাই তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানি আয় ও মূল্য সংযোজন বাড়াতে বস্ত্র খাতে নতুন করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা দরকার।

দেশের বস্ত্র খাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। বিটিএমএর সদস্যদের মধ্যে ৪৫০টি স্পিনিং, ৮৫০টি উইভিং এবং ১৭০টি ডাইং ও ফিনিশিং কারখানা রয়েছে। দেশীয় এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিট পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় সুতার ৮০-৮৫ শতাংশ এবং ওভেন পোশাকের ৩৫-৪০ শতাংশ কাপড়ের জোগান দিচ্ছে।


সুতা উৎপাদনে আমাদের অনেক কারখানা হয়ে গেছে। তবে নতুন নতুন সুতা উৎপাদনে বিনিয়োগের সুযোগ আছে। অন্যদিকে উইভিংয়ে দুর্বলতা রয়েছে।


শীর্ষ দশে যারা

বাদশা টেক্সটাইল কয়েক বছর ধরেই সুতা রপ্তানিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। অবশ্য তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে তাদের রপ্তানি কমছে। ২০১৮ সালে তারা ১৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলারের সুতা রপ্তানি করে। পরের দুই বছর প্রতিষ্ঠানটি যথাক্রমে সাড়ে ১২ কোটি ও ১১ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের সুতা রপ্তানি করেছে। বাদশা গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান কামাল ইয়ার্নও শীর্ষ দশে রয়েছে। এটি রপ্তানি মূল্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। গত বছর তাদের সুতা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৯ সালে তারা ৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার এবং ২০১৮ সালে ৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের সুতা রপ্তানি করে।


সুতা রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হলো স্কয়ার টেক্সটাইল। ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি গত বছর ৯ কোটি ৭১ লাখ ডলার মূল্যের ৩ কোটি ২৩ লাখ কেজি সুতা রপ্তানি করেছে। আগের দুই বছরের চেয়ে গত বছর ভালো কেটেছে স্কয়ারের। আগের ২০১৮ ও ২০১৯ সালে স্কয়ার টেক্সটাইল যথাক্রমে ৫ কোটি ৯৪ লাখ ও ৮ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের সুতা রপ্তানি করেছে।

তৃতীয় স্থানে রয়েছে এমএসএ স্পিনিং লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর ৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার মূল্যের ২ কোটি ৫৬ লাখ কেজি সুতা রপ্তানি করেছে। তার আগের বছর তাদের রপ্তানি ছিল ৬ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।

এএ কোয়ার্স স্পান দুই বছর আগে শীর্ষ দশে স্থান পায়। গত বছর তারা ৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের সুতা রপ্তানির সুবাদে পঞ্চম স্থানে চলে এসেছে।

পাহাড়তলী টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি মিলস ৫ কোটি ৯ লাখ ডলারের রপ্তানি নিয়ে ষষ্ঠ স্থান পেয়েছে। ৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের রপ্তানির সুবাদে এমএসএ টেক্সটাইল সপ্তম স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম স্থানে থাকা ম্যাকসনস স্পিনিং মিলস ৪ কোটি ৮৫ লাখ, নবম অবস্থানের এনআরজি স্পিনিং মিলস ৪ কোটি ৬৭ লাখ এবং দশম স্থান পাওয়া পাকিজা কটন স্পিনিং মিলস ৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের সুতা রপ্তানি করেছে।


জানতে চাইলে বাদশা টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদশা মিয়া সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুতা উৎপাদনে আমাদের অনেক কারখানা হয়ে গেছে। তবে নতুন নতুন সুতা উৎপাদনে বিনিয়োগের সুযোগ আছে। অন্যদিকে উইভিংয়ে দুর্বলতা রয়েছে। সে কারণে প্রচুর পরিমাণ ওভেন কাপড় আমদানি করতে হয়।’


দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার

বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী ভারত তাদের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের রপ্তানি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে তিন বছরের মধ্যে দেশজুড়ে সাতটি বৃহৎ টেক্সটাইল পার্ক বা বস্ত্রপল্লি করার পরিকল্পনা করেছে। একেকটি বস্ত্রপল্লি ১ হাজার একরের বেশি জমির ওপর স্থাপিত হবে, যেখানে থাকবে বিশ্বমানের অবকাঠামো। এদিকে বাংলাদেশের এখনো দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ৫০০ একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে পোশাকপল্লি। তবে সেখানে প্রাথমিকভাবে যাচ্ছে মাত্র ৩৭টি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে বস্ত্র খাতের মাত্র ৫-৭টি কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ হচ্ছে।

জানতে চাইলে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমাদের বস্ত্র মন্ত্রণালয় সরকারের করপোরেশনের মতো পরিচালিত হচ্ছে। মনে হয়, সরকারি মিলকারখানা দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। ভারতে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ৩০ বছর ধরে আছেন। আর আমাদের দেশের সচিব বস্ত্র খাত বুঝতে বুঝতেই অবসরে বা অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যান। বস্ত্র খাতের উন্নয়নের জন্য বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন।


বছরে ৬০০ কোটি মিটার কাপড় আমদানির তথ্য উল্লেখ করে বিটিএমএর সভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, বস্ত্রকলে তুলার পর অন্যতম কাঁচামাল হচ্ছে গ্যাস। বর্তমানে যাদের গ্যাসের লাইন আছে, তারাই কারখানা সম্প্রসারণে গ্যাস পাচ্ছে। নতুন কারখানা করে গ্যাসের লাইন পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে বস্ত্র খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী কাজ করা হলে বস্ত্র খাত শক্তিশালী হবে। তাতে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকের ব্যবসাও বাড়বে।


No comments

Theme images by Jason Morrow. Powered by Blogger.