করোনা সংকটে দাতারা ২৬ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা গত ১৫ জুন একটি ওয়েবিনারে (ভার্চ্যুয়াল সেমিনার) বক্তব্য দেন। সেমিনারের বিষয় ছিল, কোভিড-পরবর্তী আর্থিক ব্যবস্থাপনা স্থিতিশীল রাখতে কী করা দরকার। এতে নানা দেশের বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে সদস্যদেশগুলোর প্রতি বলেন, ‘দয়া করে, যত পারেন খরচ করেন, কিন্তু খরচের রসিদটি রাখবেন।’
অর্থনীতিকে চাঙা রাখতেই খরচের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে বলেন আইএমএফের প্রধান। এর মানে দাঁড়ায়, ঋণ পাওয়ার শর্ত নমনীয় থাকবে। তবে অর্থ খরচে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে।
কোভিড-১৯-এর কারণে লকডাউন ঘোষণা করায় দেশে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ হয়, রাজস্ব আদায় কমে। অর্থনীতি থমকে দাঁড়ায়। ফলে অর্থসংকটে পড়ে অনেক দেশ। তাই অর্থায়নের বিকল্প উৎস হিসেবে দাতা সংস্থাগুলোর কাছে হাত পাতে বহু দেশ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দাতারা সদস্যদেশগুলোর জন্য বিশাল বিশাল তহবিল গঠন করে, যাতে তারা করোনা মোকাবিলা ও অর্থনীতি চাঙা করতে পারে। শর্ত শিথিল করে দ্রুত অর্থ ছাড় করা হয়।
বাংলাদেশ করোনা সংকট মোকাবিলায় প্রকল্প সাহায্য পাওয়ার চেয়ে বাজেট সহায়তা পেতেই বেশি আগ্রহী। গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে সরকার ৩১০ কোটি ডলার সহায়তা পেয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই টাকার অর্ধেকই বাজেট সহায়তা। আর বেশির ভাগ অর্থ সরকারের হাতে এসে গেছে। এই পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) করোনা মোকাবিলায় অর্থ সহায়তা করেছে। এখনো আরও সোয়া ২০০ কোটি ডলারের মতো সহায়তা পাইপলাইনে আছে। করোনা সংকট মোকাবিলায় দাতাদের অর্থে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
বাজেট সহায়তা নেওয়ার সুবিধা হলো, সরকার এই অর্থ ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারে। এ জন্য বিশেষ কোনো প্রকল্প নিয়ে হয় না। তবে নানা ধরনের সংস্কারের শর্ত থাকে। সংস্কার না হওয়ায় কিস্তি আটকে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এবার সেই শর্ত শিথিল করা হয়েছে। করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোথায় খরচ হবে, তা জানিয়েই বাজেট সহায়তার অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্পের চেয়ে বাজেটের জন্য সহায়তা চাওয়ার সিদ্ধান্তটি তুলনামূলক ভালো। প্রকল্প প্রণয়ন করে একনেকে অনুমোদনের পর কাজ শুরু করতে করতে এক বছর লেগে যায়। এর আগে দাতাদের অর্থ হাতে পাওয়া যায় না। এবার বাজেট সহায়তা পেতে আগের মতো কঠিন শর্ত দেওয়া হচ্ছে না। কোথায় খরচ হবে, তা জানালেই অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। আবার এক কিস্তিতেই সব টাকাও পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য তেমন একটা হচ্ছে না। তাই সরকার কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্বও আদায় করতে পারছে না। এমন অবস্থায় অর্থায়নের বিকল্প উৎস হলো দাতারা। তবে শর্ত শিথিলের সুযোগে টাকা খরচে যেন স্বচ্ছতা থাকে।
কোন দাতা কত দিল
গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সর্বোচ্চ ১৬০ কোটি ডলার দিয়েছে, যা করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খরচ হবে। সংস্থাটি থেকে জুনেই এসেছে ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন, মহাসড়কে ডিজিটাল সংযোগের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য প্রায় সোয়া শ কোটি ডলারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে করোনা মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংক ১০ কোটি ডলার দেয়।
এডিবি সব মিলিয়ে গত তিন মাসে ৬০ কোটি ২৮ লাখ ডলার দিয়েছে। এর মধ্যে মে মাসে ৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা দিয়েছে এডিবি। এই টাকা দিয়ে মূলত ২০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে ২ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতনভাতা দেওয়ার তহবিলে কাজে লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া দেশে করোনার চিকিৎসা ও সুরক্ষাসামগ্রী কেনার জন্য এডিবির জরুরি তহবিল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ১০ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে। বাকি অর্থ অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে।
নানা শর্তের কারণে আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ পাওয়া তুলনামূলক কঠিন। এবার সেই আইএমএফের কাছ থেকে মাত্র এক মাসের দর-কষাকষিতে ৭৩ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা মিলেছে। গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে এই অর্থ বাংলাদেশে চলে এসেছে।
চীনের নেতৃত্বে গঠিত এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) গত এপ্রিল মাসে ১৭ কোটি ডলার দিয়েছে।
পাইপলাইনে আরও সোয়া ২০০ কোটি ডলার
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) করোনা মোকাবিলায় চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে দাতাদের কাছ থেকে আরও সোয়া ২০০ কোটি ডলার পাওয়ার আশা করছে, যা দেশের প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার সমান।
চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সব মিলিয়ে ৭৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পেতে পারে বাংলাদেশ। বাজেট সহায়তা হিসেবে ডিপিসির তৃতীয় কিস্তিতে আসবে আরও ২৫ কোটি ডলার। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের কাছে নতুন করে ৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে সরকার।
এই বিষয়ে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব শাহাবুদ্দীন পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন বাজেট সহায়তা নিয়ে এ মাসেই আলোচনা শুরু হতে পারে। আমরা এই বাজেট সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী।’
গত জুন মাসে এডিবির কাছে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ১০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে সরকার। তবে এখনো অনুমোদন মেলেনি, আলোচনা চলছে।
এ ছাড়া এআইআইবির কাছে ২৮ কোটি ডলার ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) কাছে ১৫ কোটি ডলার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে।
No comments